দুবাই বসে চীনাদের প্রতারণার ফাঁদ
একটি ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করলে ১০০ টাকা। দুটি করলে ২০০। প্রথমে এমন প্রস্তাব আসে প্রতারক চক্রের কাছ থেকে। ঘরে বসে এমন কাজের লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে কুষ্টিয়ার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মেহেদি হাসান রাসেল রাজি হন। সাবসস্ক্রাইব করে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৬০০ টাকা পান তিনি। আস্থা অর্জন করতে প্রথম পর্যায়ে চক্রের বিনিয়োগ এটি, তা বুঝতে পারেননি তিনি। পরে তাঁকে অনলাইনে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ৪০ মিনিট পরই ৬০০ টাকা লভ্যাংশসহ মূলধন ফেরত পান তিনি। কিন্তু আরও বিনিয়োগের পর চক্রের কাছে আটকে যান। ফাঁদে পড়ে তিন দিনে ৮ লাখ টাকা খুইয়েছেন মেহেদি।
এভাবে অনলাইনে বিনিয়োগের নামে দেশ থেকে গত তিন মাসে ২৭০ কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ১২টি ব্যাংক হিসাব নম্বর থেকে এই অর্থ পাচার হয়েছে। বাইন্যান্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে টাকা ডলারে রূপান্তরিত করে দুবাইয়ে পাচার করা হয়। এই চক্রটির হোতা চীনা নাগরিকরা। তারা প্রতারণার জন্য দুবাইয়ে প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে বলে জানতে পেরেছে সিআইডি। তাদের সহযোগী হিসেবে দ্বিতীয় ধাপে কাজ করে নেপালের নাগরিক। তৃতীয় ধাপে দুবাইয়ে প্রতারণার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা বাংলাদেশিরা রয়েছে। চতুর্থ ধাপে কাজ করে বাংলাদেশে থাকা তাদের সদস্যরা।
দুবাইয়ে প্রতারকদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোহাম্মদ মেজবাউদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন সুলতানা দেশে আসার পর সম্প্রতি সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার উত্তর কামারগাঁওয়ে। মেজবাউদ্দিন দেড় লাখ টাকা বেতনে আর তাঁর স্ত্রী ১ লাখ টাকা বেতনে দুবাইয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৪০০ মোবাইল ফোন নম্বর রোমিং করে দুবাইয়ে নিয়ে গেছেন এই দম্পতিসহ চক্রের সদস্যরা। এই দম্পতির কাজ ছিল রোমিং করা নম্বর থেকে দেশের বিভিন্ন ব্যক্তিকে কল করে ঘরে বসে কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া। একই সঙ্গে কোনো কোনো ব্যক্তিকে ব্যাংক হিসাব নম্বর খোলার প্রস্তাব দিতেন। ওই ব্যাংক হিসাবে যত টাকা লেনদেন হতো তার ১ শতাংশ হিসাব নম্বরধারী কমিশন পেতেন। সাধারণ মানুষ অনলাইনে বিনিয়োগের নামে ওইসব ব্যাংক হিসাব নম্বরে টাকা জমা দিতেন। এসব ব্যাংক হিসাব নম্বর পরিচালনা করে চীনারা। তদন্তে নেমে সিআইডি ১২টি ব্যাংক হিসাব নম্বর পেয়েছে, যাতে তিন মাসে ২৭০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই টাকা বাইন্যান্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ডলারে রূপান্তরিত করে দুবাইয়ে পাচার হয়।
সিআইডি বলছে, এই ১২টি ছাড়াও অসংখ্য ব্যাংক হিসাব রয়েছে চক্রের। পাচার হওয়া টাকার পরিমাণও অনেক বেশি হতে পারে। প্রায় প্রতিদিনই ভুক্তভোগীরা সিআইডিতে যোগাযোগ করছে।
প্রথমে প্রতারক চক্রের সদস্যরা রোমিং করা মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে অনলাইনে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। নম্বর দেখে মনে হবে, কল দেশ থেকেই দেওয়া হয়েছে। কেউ রাজি হলে বলা হয়, হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে তাদের আরেকজন সদস্য যোগাযোগ করবে।
হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করে ইউটিউবের দুটি লিংক পাঠানো হয়। দুটি সাবস্ক্রাইব করে তাৎক্ষণিকভাবে বিকাশ নম্বরে ২০০ টাকা পেয়ে যান সেই ব্যক্তি। ঘরে বসে এবং কোনো ঝামেলা ছাড়াই টাকা আয় হওয়ায় কারও সাধারণত সন্দেহ হয় না। সাবস্ক্রাইবের ফাঁকে টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হয়। পরে চক্রটি টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত করে নেয়। সেই সঙ্গে তাদের তৈরি করা ও নিয়ন্ত্রিত ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করিয়ে নেওয়া হয়। এর পর অর্থ বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয় তারা। ২ হাজার টাকা বিনিয়োগে ২ হাজার ৬০০ টাকা, ৫ হাজারে ৭ হাজার, ১০ হাজারে ১৪ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়। এভাবে ৮-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়। টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। প্রথম বিনিয়োগের পর লভ্যাংশসহ মূলধন ফেরত দেয় চক্র। পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগ করলে সেই টাকা উত্তোলনের জন্য নানা কারণ দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রের সদস্যরা।
গত জানুয়ারিতে রাজধানীর দক্ষিণখানের আমেনা বেগম নামে এক নারীর কাছ থেকে ১০ লাখ ২৯ হাজার ৫৪২ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। মাটিকাটা এলাকার মোতাসিম নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২৬ লাখ টাকা, নুর আলম জিকুর ২ লাখ ১১ হাজার, হাতিরপুলের অলোক সাহার কাছ থেকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি ১৪ লাখ টাকা, আব্দুর রহমান ৩২ লাখ টাকা, আবু শোয়েব ৩০ লাখ টাকা, সাভারের রেপোনা খানম ৪ লাখ টাকা, কুষ্টিয়ার মেহেদি হাসান রাসেল নামে এক ব্যক্তি ৮ লাখ টাকা খুইয়েছেন।
ভুক্তভোগী মেহেদি হাসান রাসেল সমকালকে বলেন, ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে ৩-৪ ঘণ্টায় ৬০০ টাকা বিকাশে পেয়েছিলেন তিনি। পরে তাদের কথা মতো ২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ২৬শ টাকা পান। এর পর ৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। তাদের দেওয়া সিটি ব্যাংক হিসাব নম্বরে টাকা জমা দেন তিনি। হিসাব নম্বরটি কুমিল্লার মোশারফ এগ্রো ফার্ম নামে খোলা। ৫ হাজার টাকা দেওয়ার পর তারা আরও ১২ হাজার ৫০০ টাকা বিনিয়োগ করতে বলে। এই টাকা না দিলে আগের ৫ হাজার টাকা পাওয়া যাবে না বলে জানানো হয়। পরে বলে, ঝামেলা হয়েছে। আরও ২৮ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে লভ্যাংশসহ মূলধন ফেরত পাওয়া যাবে বলা হয়। এভাবে তিন দিনে তাঁর কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
প্রতারণার শিকার হয়ে ঢাকার দক্ষিণখান থানা ও নিউমার্কেট থানায় দু’জন ভুক্তভোগী সম্প্রতি মামলা করেন। দক্ষিণখান থানায় দায়ের করা মামলাটির বাদি আমেনা বেগম এজাহারে উল্লেখ করেন– গত ২৪ জানুয়ারি অচেনা এক নারী তাঁর ফোনে কল করে ঘরে বসে অনলাইনে কাজের প্রস্তাব দেন। তিনি রাজি হলে আরেক ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে এবং ইউটিউব চ্যানেলের লিংক দিয়ে সাবসক্রাইব করতে বলে। সাবসক্রাইব করে তিন দিনে তিনি সাড়ে ৪ হাজার টাকা আয় করেন চক্রের কাছ থেকে। এরই মধ্যে টেলিগ্রামে আরেকজন কথা বলে তাঁর সঙ্গে। পরে ওয়েবসাইটে বিনিয়োগের কথা বলে। প্রথম ধাপে লভ্যাংসসহ মূলধন ফেরত পেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপের মূলধন আটকে দেয় চক্রটি। এর পর সেটি উত্তোলনের নামে পর্যায়ক্রমে ১০ লাখ ২৯ হাজার ৫৪২ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলার বাদী আমিরুল মোস্তফা মোহাম্মদ ফজলুর রশিদ এজাহারে উল্লেখ করেন– প্রতারক চক্র তাঁর কাছ থেকে ২৪ লাখ ৫৯ হাজার ৭৩৮ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টার মামলা দুটির তদন্ত করছে। তদন্তে নেমে মেজবাউদ্দিন ও ইয়াসমিন সুলতানা ছাড়াও অন্য পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তারা হলেন– পঞ্চগড় জেলার ইসলামবাগ গ্রামের মোসাদ্দেকুর রহমান ওরফে নীড়, কায়েতপাড়ার আনোয়ার হোসেন ও চন্দনপাড়ার শাহিন ইসলাম, চাঁদপুরের উত্তর মতলব এলাকার মুক্তিরকান্দি গ্রামের সাদ্দাম হোসেন এবং যশোরের বেজপাড়ার আশিকুর রহমান। তাদের কেউ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট, কেউ ব্যাংক হিসাব নম্বরধারী। তারা চক্রের হোতাদের সহযোগী।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ রাজীবুল হাসান সমকালকে বলেন, প্রতারণা চক্রের আরও সদস্য রয়েছে দেশে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
পশ্চিম যাত্রাবাড়ী, মদিনা মেডিকেল, ০৯ তালা।
সম্পাদক ও প্রকাশক
হুমায়ুন কবির সাগর
পরিচালক
মাহবুব আলম সৈকত
নিউজ
ফোনঃ +৮৮ ০১৭৭৫২১১১১৭
Email: searchbdnews@gmail.com
বিজ্ঞাপণ
ফোনঃ +৮৮ ০১৭৭৫২১১১১৭
Email: ads@searchbdnews.com
©২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || Serach BD News