কিট তৈরিতে পুকুর চুরি
করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের কিট তৈরির প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (বিআরআইসিএম) এই কিট তৈরির কাঁচামাল আমদানির অনুমোদন পায়। ‘বায়োকেমিকো মলিক্যুলার (ইনভিট্রো) প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দেশীয় সক্ষমতা সৃষ্টি’ শীর্ষক এ প্রকল্পের অধীনে করোনাভাইরাস শনাক্তে নমুনা সংগ্রহের জন্য ভাইরাল ট্রান্সপোর্ট মিডিয়া (ভিটিএম) কিট তৈরিতে দরপত্র ছাড়াই ১৪ কোটি টাকার কাঁচামাল কেনা হয়। পরে সাজানো দরপত্রে ক্রয়মূল্য দ্বিগুণ দেখিয়ে ২৯ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খান ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ফরিদুল ইসলাম বাপ্পী। এ ছাড়া ১০ জন আউটসোর্সিং কর্মী কাজ করলেও ২০ জনের বেতন-ভাতা তোলা হয়েছে। বিআরআইসিএম সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পর এই ভাইরাস শনাক্তে নমুনা সংগ্রহের জন্য ভিটিএম আমদানি শুরু করে সরকার। ব্যাপক চাহিদা থাকায় বিআরআইসিএম সিডিসি গাইডলাইন মেনে দেশেই ভিটিএম তৈরি শুরু হয়। এর জন্য পাঁচটি লটে ১৪ কোটি টাকার কাঁচামাল কেনা হয়। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিভিন্ন সরবরাহকারী থেকে নেওয়া হলেও সাজানো দরপত্রে দ্য নেক্সট ফিউচার ও মেসার্স রামিছা ট্রেডার্স দুটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে বলে দেখানো হয়। এ দুই প্রতিষ্ঠানের মালিক ফরিদুল ইসলাম বাপ্পী।
কাঁচামালগুলোর বিলের কাগজ যাচাই করে দেখা যায়, বেশকিছু পণ্য কম দামে কিনে দরপত্রে অধিক দাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সোয়াব স্টিক ৩৮ টাকা জোড়া কিনে সাজানো দরপত্রে ৭৪ টাকা করে ক্রয় দেখানো হয়। ভিটিএমের ভায়াল সাড়ে তিন টাকা থেকে সাড়ে চার টাকা করে কিনে তা ১৩ টাকা ক্রয় দেখানো হয়। ভিটিএম ম্যানুয়াল ৩ পয়সা করে কিনে দুই টাকা করে, টাং ডিপ্রেশর ১ টাকায় কিনে ৩ টাকা দরপত্রে ক্রয় দেখানো হয়। এ ছাড়া জেন্টামাইসিন, ফ্লু কোনাজল, ফিল্টারসহ বিভিন্ন কাঁচামালের ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্রয় ও প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে দরপত্রে পরিমাণ ও দাম দুইই বহুগুণ বাড়িয়ে ক্রয় দেখানো হয়। ২৪ লাখ ভিটিএম উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জেন্টামাইসিনের পরিমাণ ১.৩ কেজি হলেও ১৬ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে কেনা জেন্টামাইসিনকে টেন্ডারে দেখানো হয় ৪৫ হাজার টাকা কেজি এবং পরিমাণ উল্লেখ করা হয় ৫৮ কেজি। এসব অনিয়মের মাধ্যমে দা নেক্সট ফিউচারের ফরিদুল ইসলাম বাপ্পির সহযোগিতায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
এই কেনাকাটা দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক আবু বিন হাসান সুসান। তিনি সমকালকে বলেন, ‘শুরু থেকে আমি উন্মুক্ত দরপত্রে করার জন্য বলে আসছিলাম। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খান আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম এভাবে কেনাকাটা করলে এক সময় ফেঁসে যাবেন।’
টাকা আত্মসাতে গায়েবি কর্মী
কাগজে কলমে দুই বছর ধরে বিআরআইসিএমে আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে কাজ করেন শিরিন আক্তার। দৈনিক হাজিরা খাতায় সইও রয়েছে তাঁর। মাঝেমধ্যে শারীরিক অসুস্থতা দেখিয়ে ছুটি নিয়েছেন এই কর্মী। মাস শেষে পারিশ্রমিকও তুলছেন। তবে বাস্তবে শিরিন আক্তার নামে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মী এ প্রতিষ্ঠানে নেই। তাঁর মতো এমন মোট ১০ গায়েবি কর্মীর বেতন দিচ্ছে বিআরআইসিএম প্রশাসন।
অভিযোগ উঠেছে, বিআরআইসিএমের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খান ও কর্মী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠা মেসার্স বাপ্পি ট্রেডার্সের মালিক ফরিদুল ইসলাম বাপ্পীর যোগসাজশে এমন গায়েবি কর্মী দেখিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রতি মাসে ১০ কর্মীর বেতন বাবদ ২ লাখ ২৩ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। এ টাকা থেকে বাপ্পি ট্রেডার্সের মালিককে ৯ শতাংশ টাকা দিয়ে বাকি টাকা মালা খান রেখে দিতেন। এভাবে গত তিন বছরে ৫৭ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। বিআরআইসিএম সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে দুই দরপত্রে ২০ জন আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতি মাসে দুটি চেকে তিন লাখ টাকা উঠানো হয়।
প্রতিষ্ঠানটির অন্য কর্মকর্তারা এমন দুর্নীতির বিষয় শুরু থেকেই জানতেন। তবে ভয়ে এতদিন তারা মুখ খোলেননি। সহকারী হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা আশরাফুল আমিন বলেন, ‘২০ আউটসোর্সিং কর্মীর বেতন দুই চেকের মাধ্যমে মেসার্স বাপ্পি ট্রেডার্সের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হতো। তিনি তাঁর ৯ শতাংশ কমিশন নিয়ে বাকি টাকা মালা খানের কাছে দিতেন। মালা খান আমাদের যা অর্ডার দিতেন, তাই করতে হতো।’
অভিযুক্ত ফরিদুল ইসলাম বাপ্পী সমকালকে বলেন, আইন মেনে দরপত্রে অংশ নিয়েছি। পণ্যের মূল্য বেশি হলে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ ছিল। তারা সেই সময় কিছুই বলেনি। গায়েবি কর্মী দেখিয়ে টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের নামে চেক হলেও এই টাকা আমি পেতাম না। আমাকে শুধু চেক দেওয়া হতো। টাকা নিতেন মালা খান। অভিযোগের বিষয় তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানান মালা খান। দোষী প্রমাণিত হলে কর্তৃপক্ষ যে ব্যবস্থা নেবে, তা তিনি মেনে নিতে রাজি।’
পড়ে আছে কোটি কোটি টাকার কিট তৈরির যন্ত্র
করোনার কিট তৈরির ১৪ কোটি টাকার যন্ত্র পড়ে আছে। কাগজে কলমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাজ্জাক ইন্টার-ট্রেড (এমআইটি) এ যন্ত্র সরবরাহ করে বলে দেখানো হয়। তবে এসব যন্ত্র সরবরাহ করছে ডিএনএ সল্যুশন লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. ফজলে রাব্বী। তিনি সমকালকে বলেন, মূলত একটি প্রকল্পের অধীনে এই যন্ত্রগুলো বিআরআইসিএম আমদানি করে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে যন্ত্র ফিরিয়ে নেব। দরপত্র ছাড়া কীভাবে যন্ত্র সরবরাহ করেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পটি অনুমোদন হলে দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনা ছিল।
বিআরআইসিএমের মহাপরিচালক ড. এ কে এম আজাদুর রহমান বলেন, ‘দুই মাস হলো আমি এ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছি। এমন অনিয়মের অভিযোগ শুনেছি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলতে পারব।’
পশ্চিম যাত্রাবাড়ী, মদিনা মেডিকেল, ০৯ তালা।
সম্পাদক ও প্রকাশক
হুমায়ুন কবির সাগর
পরিচালক
মাহবুব আলম সৈকত
নিউজ
ফোনঃ +৮৮ ০১৭৭৫২১১১১৭
Email: searchbdnews@gmail.com
বিজ্ঞাপণ
ফোনঃ +৮৮ ০১৭৭৫২১১১১৭
Email: ads@searchbdnews.com
©২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || Serach BD News